কিভাবে করবো

সিফিলিস টেস্ট কিভাবে করবো? [Detail Guide]

5/5 - (1 vote)

সিফিলিস একটি মারাত্মক যৌনবাহিত রোগ, যা Treponema pallidum নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে হয়। সঠিক সময়ে সিফিলিস শনাক্ত করা এবং চিকিৎসা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দীর্ঘমেয়াদে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। এই নিবন্ধে আমরা সিফিলিস টেস্ট করার পদ্ধতি, প্রস্তুতি, খরচ, এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য তথ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

সিফিলিস টেস্ট কিভাবে করবো?
সিফিলিস টেস্ট কিভাবে করবো?

সিফিলিস টেস্টের প্রকারভেদ

সিফিলিস শনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরণের টেস্ট রয়েছে, যা প্রধানত রক্তের নমুনা নিয়ে করা হয়। নিচে প্রধান টেস্টগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

  1. স্ক্রিনিং টেস্ট:
    • VDRL (Venereal Disease Research Laboratory): এটি একটি সাধারণ রক্ত পরীক্ষা, যা সিফিলিসে আক্রান্ত হলে শরীরে অ্যান্টিবডি উপস্থিতি শনাক্ত করে।
    • RPR (Rapid Plasma Reagin): এটি VDRL-এর মতোই একটি টেস্ট, তবে এতে দ্রুত ফলাফল পাওয়া যায়।
  2. নিশ্চিতকরণ টেস্ট:
    • FTA-ABS (Fluorescent Treponemal Antibody Absorption Test): সিফিলিসের উপস্থিতি নির্দিষ্ট করতে এটি একটি বিশ্বাসযোগ্য পদ্ধতি।
    • TPPA (Treponema Pallidum Particle Agglutination Test): সিফিলিস ব্যাকটেরিয়ার অ্যান্টিবডি নির্ণয় করতে এটি করা হয়।
  3. ডার্কফিল্ড মাইক্রোস্কপি: সিফিলিসের আলসার বা ক্ষত থেকে নমুনা নিয়ে সরাসরি ব্যাকটেরিয়া দেখা যায়।
  4. PCR (Polymerase Chain Reaction): ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিফিলিস শনাক্ত করার একটি অত্যন্ত নির্ভুল পদ্ধতি।

সিফিলিস টেস্ট করার প্রয়োজনীয়তা

সিফিলিসের প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণসমূহ সুস্পষ্ট না হওয়ায় অনেকেই বুঝতে পারেন না যে তারা আক্রান্ত। তাই নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে সিফিলিস টেস্ট করা উচিত:

  • অরক্ষিত যৌনসম্পর্ক: যদি আপনি অরক্ষিত যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হয়ে থাকেন।
  • নতুন যৌনসঙ্গী: নতুন সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের আগে।
  • গর্ভাবস্থা: গর্ভবতী নারীদের সিফিলিস টেস্ট করা উচিত, কারণ এটি গর্ভস্থ শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
  • সিফিলিসের লক্ষণ: যদি শরীরে অজানা ক্ষত, ফুসকুড়ি, বা অন্যান্য সিফিলিসের লক্ষণ দেখা যায়।

সিফিলিস টেস্টের প্রস্তুতি

সিফিলিস টেস্ট করার জন্য বিশেষ কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র নির্ধারিত প্যাথলজি ল্যাব বা হাসপাতালে গিয়ে রক্তের নমুনা প্রদান করতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে, যদি ক্ষত বা আলসার থাকে, তবে সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হতে পারে।

সিফিলিস টেস্টের খরচ

বাংলাদেশে সিফিলিস টেস্টের খরচ ল্যাব এবং এলাকার উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। সাধারণত সরকারি হাসপাতালে এই টেস্টের খরচ ১৫০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে হয়। বেসরকারি ল্যাবে এই খরচ ২৫০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। তবে, কিছু উন্নত এবং নির্দিষ্ট টেস্টের জন্য খরচ আরও বেশি হতে পারে।

সিফিলিস প্রতিরোধে করণীয়

সিফিলিস প্রতিরোধে সচেতনতা এবং সতর্কতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা উল্লেখ করা হলো:

  • নিরাপদ যৌনসম্পর্ক: সর্বদা কনডম ব্যবহার করা উচিত।
  • নিয়মিত টেস্ট: ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের পর নিয়মিত সিফিলিসসহ অন্যান্য যৌনবাহিত রোগের টেস্ট করা।
  • সঙ্গীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা: নতুন সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের আগে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া।
  • শিক্ষা ও সচেতনতা: সিফিলিসের লক্ষণ, সংক্রমণ পদ্ধতি, এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে জানা এবং অন্যদের সচেতন করা।

সিফিলিসের চিকিৎসা

সিফিলিসের প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে এটি সহজেই চিকিৎসাযোগ্য। সাধারণত পেনিসিলিন ইনজেকশনের মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। যদি কেউ পেনিসিলিনে অ্যালার্জিক হয়, তবে বিকল্প অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে। চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে যৌনসম্পর্ক থেকে বিরত থাকা এবং সঙ্গীকেও টেস্ট ও চিকিৎসা করানো উচিত।

সিফিলিস টেস্টের ফলাফল বোঝার উপায়

সিফিলিস টেস্টের ফলাফল প্রধানত পজিটিভ (+), নেগেটিভ (-), বা অস্পষ্ট (ইনকনক্লুসিভ) হতে পারে।

১. পজিটিভ ফলাফল

যদি পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হয়, তাহলে এর অর্থ আপনি সিফিলিস আক্রান্ত হয়েছেন বা অতীতে সংক্রমিত হয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যাবশ্যক

২. নেগেটিভ ফলাফল

যদি ফলাফল নেগেটিভ হয়, তাহলে সাধারণত সিফিলিস সংক্রমণ নেই। তবে, যদি সংক্রমণের শুরুর দিকে টেস্ট করা হয়, তাহলে ফলাফল ভুল হতে পারে (False Negative)। সেক্ষেত্রে, ডাক্তার পুনরায় টেস্ট করার পরামর্শ দিতে পারেন

৩. অস্পষ্ট বা ইনকনক্লুসিভ ফলাফল

কিছু ক্ষেত্রে টেস্টের ফলাফল সুস্পষ্ট না-ও হতে পারে। এটি হলে, আরও নির্ভুল পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে যেমন FTA-ABS বা TPPA

সিফিলিসের বিভিন্ন ধাপ এবং টেস্টের গুরুত্ব

সিফিলিস সংক্রমণের চারটি প্রধান ধাপ রয়েছে, যা বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণ দেখায়:

১. প্রাথমিক পর্যায় (Primary Syphilis)

  • সাধারণত ১০-৯০ দিনের মধ্যে একটি বা একাধিক ক্ষত (chancre) দেখা যায়।
  • এই পর্যায়ে ডার্কফিল্ড মাইক্রোস্কপি বা PCR টেস্ট সবচেয়ে কার্যকর।

২. মাধ্যমিক পর্যায় (Secondary Syphilis)

  • সংক্রমণের কয়েক সপ্তাহ পরে শরীরে ফুসকুড়ি, জ্বর, মাথাব্যথা, লিম্ফনোড ফুলে যাওয়া দেখা যেতে পারে।
  • VDRL, RPR, এবং FTA-ABS টেস্ট এই পর্যায়ে কার্যকর।

৩. সুপ্ত বা ল্যাটেন্ট পর্যায় (Latent Syphilis)

  • লক্ষণ নেই, তবে রোগটি শরীরে থেকে যায়।
  • TPPA বা FTA-ABS টেস্ট এই পর্যায়ে সংক্রমণ শনাক্ত করতে পারে।

৪. তৃতীয় পর্যায় (Tertiary Syphilis)

  • হৃদরোগ, মস্তিষ্কের সমস্যা, স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে।
  • এই পর্যায়ে পূর্বের টেস্টগুলোর পাশাপাশি CSF (Cerebrospinal Fluid) বিশ্লেষণ করা হয়।

সিফিলিস টেস্ট কোথায় করানো যায়?

বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, এবং ল্যাবরেটরিতে সিফিলিস টেস্ট করানো যায়।

সরকারি হাসপাতাল ও সংস্থা:

  • বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্স (BIHS)
  • জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (IEDCR)
  • সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক:

  • Popular Diagnostic Center
  • LabAid Diagnostics
  • Ibn Sina Diagnostic Center
  • Medinova Medical Services

অনলাইন ভিত্তিক টেস্ট বুকিং: বর্তমানে Praava Health, Thyrocare, এবং Pathao Health এর মতো প্ল্যাটফর্মেও সিফিলিস টেস্ট বুক করা সম্ভব।

গর্ভবতী নারীদের জন্য সিফিলিস টেস্টের গুরুত্ব

গর্ভাবস্থায় সিফিলিস থাকলে Congenital Syphilis হতে পারে, যা নবজাতকের জন্য মারাত্মক হতে পারে। প্রসবকালীন বা গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে টেস্ট করানো জরুরি

গর্ভবতী নারীদের জন্য করণীয়:

  • প্রথম ত্রৈমাসিকে সিফিলিস টেস্ট করানো।
  • সন্দেহজনক হলে গর্ভকালীন পুরো সময়ে নিয়মিত ফলোআপ টেস্ট করানো।
  • সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করে নবজাতকের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়ানো।

সিফিলিস টেস্ট সংক্রান্ত প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs)

১. সিফিলিস টেস্ট কি বাড়িতে করা যায়?

হ্যাঁ, কিছু হোম টেস্ট কিট পাওয়া যায়, তবে এগুলোর নির্ভুলতা ল্যাব টেস্টের তুলনায় কম। বাড়িতে টেস্ট করার চাইতে পেশাদার ল্যাবে রক্ত পরীক্ষা করানোই ভালো।

২. সিফিলিস টেস্ট কি HIV টেস্টের সাথে করা হয়?

হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রে সিফিলিস ও HIV টেস্ট একসাথে করার পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ দুটিই যৌনবাহিত সংক্রমণ।

৩. সিফিলিসের চিকিৎসা না করালে কী হতে পারে?

  • দীর্ঘমেয়াদী স্নায়বিক সমস্যা
  • অন্ধত্ব বা শ্রবণশক্তি হ্রাস
  • হার্ট ও মস্তিষ্কের জটিলতা
  • গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু বা জন্মগত ত্রুটি

৪. সিফিলিস টেস্টের আগে খালি পেটে থাকতে হয় কি?

না, সাধারণত সিফিলিস টেস্টের জন্য খালি পেটে থাকার প্রয়োজন নেই।

৫. সিফিলিস সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য কি?

হ্যাঁ, শুরুর দিকে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করলে সিফিলিস সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য।

সিফিলিস একটি গুরুতর যৌনবাহিত রোগ, তবে এটি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। নিয়মিত টেস্ট, নিরাপদ যৌন অভ্যাস, এবং সচেতনতা সিফিলিস প্রতিরোধের চাবিকাঠি।

Related Articles

Back to top button