জন্ম নিবন্ধন বয়স সংশোধন করার নিয়ম (Birth Registration Correction Application)
জন্ম সনদে ভুল! কার না হয়? এটা একটা অতি সাধারণ সমস্যা। কিন্তু এই সামান্য ভুল ভবিষ্যতে অনেক বড় সমস্যার কারণ হতে পারে। বিশেষ করে আপনার সন্তানের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চাকরি, পাসপোর্ট তৈরি, বিবাহ, জমি রেজিস্ট্রেশন, স্কুল বা কলেজে ভর্তি—সবক্ষেত্রেই জন্ম নিবন্ধন লাগে। আর সেই জন্ম নিবন্ধনে যদি ভুল থাকে, তাহলে ভোগান্তির শেষ থাকে না। তবে চিন্তা নেই, এখন ঘরে বসেই অনলাইনের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন সনদের ভুল সংশোধন করা যায়। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা আলোচনা করব, কিভাবে আপনি খুব সহজেই আপনার জন্ম নিবন্ধন সনদের বয়স সংশোধন করতে পারবেন। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!

জন্ম নিবন্ধন সনদে বয়স সংশোধন কেন জরুরি?
জন্ম নিবন্ধন সনদে বয়স সংশোধন করাটা কেন জরুরি, সেটা একটু বুঝিয়ে বলা যাক। ধরুন, আপনার সন্তানের জন্ম সনদে ভুল করে বয়স কম বা বেশি লেখা হয়েছে। এর ফলে কী হতে পারে?
- ভুল বয়সের কারণে স্কুলে ভর্তি হতে সমস্যা হতে পারে।
- পাসপোর্ট করতে গেলে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
- সরকারি বা বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে।
- জমির দলিল বা অন্য কোনো legal কাজে সমস্যা হতে পারে।
- মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে বয়স কম দেখালে বাল্যবিবাহের সমস্যা হতে পারে।
বুঝতেই পারছেন, একটা ছোট ভুল ভবিষ্যতে কত বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাই সময় থাকতে জন্ম সনদের বয়স সংশোধন করে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
জন্ম নিবন্ধন বয়স সংশোধন করার নিয়ম: ধাপে ধাপে গাইডলাইন
জন্ম নিবন্ধন সনদে বয়স সংশোধন করার নিয়ম এখন আগের থেকে অনেক সহজ হয়েছে। অনলাইনে কিছু ধাপ অনুসরণ করে আপনি নিজেই এই কাজটি করতে পারবেন। চলুন, ধাপে ধাপে পুরো প্রক্রিয়াটি জেনে নেওয়া যাক:
Read More – সরকারি চাকরিজীবীদের ই-পাসপোর্ট করার নিয়ম ২০২৫
১. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করা
প্রথমেই আপনাকে কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড় করতে হবে। এই কাগজপত্রগুলো আপনার বয়স সংশোধনের আবেদনকে জোরালো করবে। সাধারণত যে কাগজপত্রগুলো লাগে, সেগুলো হলো:
- আবেদনকারীর জন্ম সনদের অনলাইন কপি।
- আবেদনকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ (যদি থাকে)।
- পিতা ও মাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি।
- আবেদনকারীর বিবাহের কাবিননামা (যদি বিবাহিত হন)।
- সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের ছাড়পত্র অথবা birth certificate (যদি থাকে)।
- ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত নাগরিকত্বের সনদ।
- বয়স প্রমাণের জন্য অন্যান্য সহায়ক ডকুমেন্টস (যেমন: আইডি কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স)।
এই ডকুমেন্টসগুলো হাতের কাছে থাকলে আপনার আবেদন প্রক্রিয়াটি অনেক সহজ হয়ে যাবে।
২. অনলাইনে আবেদন করার নিয়ম
অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন সনদের বয়স সংশোধনের জন্য আপনাকে এই ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবে:
ক. জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ওয়েবসাইটে প্রবেশ
প্রথমে বাংলাদেশ সরকারের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ওয়েবসাইটে (bdris.gov.bd/home) প্রবেশ করুন।
খ. “জন্ম নিবন্ধন তথ্য সংশোধন/পুনমুদ্রণ”-এ ক্লিক করুন
ওয়েবসাইটে ঢোকার পর আপনি “জন্ম নিবন্ধন তথ্য সংশোধন/পুনমুদ্রণ” নামের একটি অপশন দেখতে পাবেন। সেখানে ক্লিক করুন।
গ. জন্ম নিবন্ধন নম্বর ও জন্ম তারিখ প্রদান
এখানে আপনার জন্ম নিবন্ধন নম্বর এবং জন্ম তারিখ সঠিকভাবে লিখুন। এরপর “অনুসন্ধান” বাটনে ক্লিক করুন।
ঘ. আবেদনপত্র পূরণ
আপনার তথ্য প্রদর্শিত হলে “নির্বাচন করুন” অপশনে ক্লিক করে ” Record Selected ” করুন। এরপর আপনাকে একটি অনলাইন আবেদনপত্র দেওয়া হবে। এই ফর্মে আপনার যা যা তথ্য পরিবর্তন করতে চান, তা উল্লেখ করুন। বিশেষ করে, জন্ম তারিখের সঠিক তথ্য দিন।
ঙ. প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস আপলোড
আবেদনপত্রে আপনার প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসগুলো স্ক্যান করে আপলোড করুন। মনে রাখবেন, ডকুমেন্টসগুলো যেন স্পষ্ট এবং পাঠযোগ্য হয়।
চ. আবেদনপত্র সাবমিট
সব তথ্য ভালোভাবে যাচাই করে “সাবমিট” বাটনে ক্লিক করুন। সাবমিট করার পর আপনাকে একটি application ID দেওয়া হবে। এটি সংরক্ষণ করুন, কারণ এটি পরবর্তীতে আপনার আবেদনের অবস্থা জানতে কাজে লাগবে।
৩. স্থানীয় নিবন্ধকের অফিসে যোগাযোগ
অনলাইনে আবেদন করার পরে, আপনার স্থানীয় নিবন্ধকের (ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস/ইউনিয়ন পরিষদ) অফিসে যোগাযোগ করা উচিত।
ক. যোগাযোগ করার নিয়ম
আবেদন করার পর application ID এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে স্থানীয় নিবন্ধকের অফিসে যান। সেখানে আপনার আবেদনের বিষয়ে বিস্তারিত জানান এবং প্রয়োজনীয় ফি পরিশোধ করুন।
খ. অনুসরণ করার নিয়ম
নিবন্ধকের অফিস থেকে আপনাকে একটি নির্দিষ্ট তারিখ দেওয়া হবে। সেই তারিখে আপনার কাগজপত্র জমা দিতে হতে পারে অথবা আরও কিছু তথ্য জানতে চাওয়া হতে পারে। তাদের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করুন।
৪. ফি পরিশোধ করার নিয়ম
জন্ম নিবন্ধন সনদে বয়স সংশোধনের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি পরিশোধ করতে হয়।
ক. ফি কত লাগবে
সাধারণত, বয়স সংশোধনের জন্য ফি ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। তবে এটি স্থানীয় নিবন্ধক অফিসের ওপর নির্ভর করে।
খ. কিভাবে পরিশোধ করবেন
আপনি নিবন্ধক অফিসে সরাসরি গিয়ে ফি পরিশোধ করতে পারবেন। এছাড়া, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনলাইনেও ফি পরিশোধ করার সুযোগ থাকে। ফি পরিশোধের রসিদটি অবশ্যই সংগ্রহ করে রাখবেন।
৫. সংশোধিত জন্ম সনদ সংগ্রহ
আপনার আবেদন সফল হলে, নিবন্ধক অফিস থেকে আপনাকে সংশোধিত জন্ম সনদ দেওয়া হবে।
ক. কতদিন লাগতে পারে
সংশোধিত জন্ম সনদ পেতে সাধারণত ৭ থেকে ১৫ দিন সময় লাগতে পারে। তবে এটি অফিসের কর্মব্যস্ততার ওপর নির্ভর করে।
খ. সংগ্রহের নিয়ম
নির্ধারিত তারিখে অফিসে গিয়ে আপনার সংশোধিত জন্ম সনদ সংগ্রহ করুন। সনদটি হাতে পাওয়ার পর ভালোভাবে যাচাই করে দেখুন যে, সব তথ্য সঠিক আছে কিনা। কোনো ভুল থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে সংশোধনের জন্য আবেদন করুন।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আপনার জানা উচিত
- আবেদন করার সময় নিজের মোবাইল নম্বর এবং ইমেইল আইডি দেওয়া ভালো। এতে আপনার সাথে যোগাযোগ করা সহজ হবে।
- যদি অনলাইনে আবেদন করতে সমস্যা হয়, তাহলে সরাসরি নিবন্ধক অফিসে গিয়েও আবেদন করতে পারেন।
- সকল ডকুমেন্টস যেন আসল হয় এবং কোনো ভুল তথ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- নিয়মিত আপনার আবেদনের অবস্থা অনলাইনে অথবা নিবন্ধক অফিসে জেনে নিন।
জন্ম নিবন্ধন বয়স সংশোধন সংক্রান্ত কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্ন এবং সেগুলোর উত্তর দেওয়া হলো, যা আপনাকে সাহায্য করতে পারে:
১. জন্ম নিবন্ধন সনদে বয়স সংশোধন করতে কী কী ডকুমেন্টস লাগে?
উত্তর: জন্ম নিবন্ধন সনদে বয়স সংশোধন করতে সাধারণত আপনার জন্ম সনদের অনলাইন কপি, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ (যদি থাকে), পিতা ও মাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, নাগরিকত্বের সনদ এবং বয়স প্রমাণের জন্য অন্যান্য সহায়ক ডকুমেন্টস লাগে।
২. বয়স সংশোধন করার জন্য অনলাইনে কিভাবে আবেদন করতে হয়?
উত্তর: অনলাইনে আবেদন করার জন্য জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে “জন্ম নিবন্ধন তথ্য সংশোধন” অপশনে ক্লিক করুন। এরপর আপনার জন্ম নিবন্ধন নম্বর ও জন্ম তারিখ দিয়ে আবেদনপত্র পূরণ করে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস আপলোড করুন।
৩. বয়স সংশোধন করার জন্য কত টাকা ফি দিতে হয়?
উত্তর: বয়স সংশোধন করার জন্য ফি সাধারণত ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এটি স্থানীয় নিবন্ধক অফিসের ওপর নির্ভর করে।
৪. সংশোধিত জন্ম সনদ পেতে কত দিন লাগতে পারে?
উত্তর: সংশোধিত জন্ম সনদ পেতে সাধারণত ৭ থেকে ১৫ দিন সময় লাগতে পারে। তবে এটি অফিসের কর্মব্যস্ততার ওপর নির্ভর করে।
৫. জন্ম নিবন্ধন সনদে ভুল থাকলে কি কি সমস্যা হতে পারে?
উত্তর: জন্ম নিবন্ধন সনদে ভুল থাকলে স্কুলে ভর্তি, পাসপোর্ট তৈরি, চাকরি, বিবাহ এবং জমির দলিলসহ বিভিন্ন আইনি কাজে সমস্যা হতে পারে।
৬. আমি কি আমার নিজের জন্ম নিবন্ধন নিজেই সংশোধন করতে পারি?
উত্তর: হ্যাঁ, আপনি যদি ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী হন, তবে আপনি নিজের জন্ম নিবন্ধন নিজেই সংশোধন করতে পারবেন।
৭. জন্ম নিবন্ধন বয়স সংশোধন করার জন্য কি কোনো সময়সীমা আছে?
উত্তর: না, জন্ম নিবন্ধন বয়স সংশোধন করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংশোধন করে নেওয়া ভালো।
৮. জন্ম সনদে দেওয়া বয়স ভুল হলে আমি কি করতে পারি?
উত্তর: জন্ম সনদে দেওয়া বয়স ভুল হলে, আপনি অনলাইনে বা স্থানীয় নিবন্ধকের অফিসে গিয়ে বয়স সংশোধনের জন্য আবেদন করতে পারেন।
৯. জন্ম নিবন্ধন বয়স সংশোধন করার আবেদন বাতিল হলে কি করব?
উত্তর: জন্ম নিবন্ধন বয়স সংশোধন করার আবেদন বাতিল হলে, আপনি বাতিলের কারণ জানতে পারবেন এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবার আবেদন করতে পারবেন।
১০. জন্ম নিবন্ধন বয়স সংশোধন করার জন্য কোথায় যোগাযোগ করব?
উত্তর: জন্ম নিবন্ধন বয়স সংশোধন করার জন্য আপনি স্থানীয় নিবন্ধকের অফিস (ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়/ইউনিয়ন পরিষদ) অথবা জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ওয়েবসাইটে যোগাযোগ করতে পারেন।
জন্ম নিবন্ধন সনদে বয়স সংশোধন করা এখন আর কঠিন কিছু নয়। একটু ধৈর্য ধরে উপরের নিয়মগুলো অনুসরণ করলে আপনি নিজেই এই কাজটি করতে পারবেন। যদি কোনো সমস্যা হয়, তাহলে স্থানীয় নিবন্ধকের অফিসে যোগাযোগ করতে দ্বিধা করবেন না। মনে রাখবেন, আপনার সামান্য সচেতনতা আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনেক উপকার বয়ে আনতে পারে।
যদি এই বিষয়ে আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আমি চেষ্টা করব আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।